ওঙ্কার। বৈদিক পূরাণ মতে 'ওঙ্কার' মানে সকল ধ্বনির মূল, সেই আদি ও অকৃত্রিম ধ্বনি।
আহমদ ছফা রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস এটি। অবশ্য এটি কি উপন্যাস না গল্পগ্রন্থ তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে, রয়ে যাবে। মেথডিক্যাল কলেবরের আকার-আকৃতি সূচক যে পশ্চিমা ধারণা আছে সেটির সাথে এই আখ্যানটি যায় না।
টাইমলাইন ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ এর অগ্নিঝড়া সময়। উত্তম পুরুষে রচিত এমন একধরণের গদ্যকাব্য ধরণে গল্প এগিয়ে যায়। যে গল্পে বিভিন্ন চরিত্রের কোন নাম নেই। দু'একটি চরিত্র ছাড়া নামহীন কেন এই উপন্যাস?
'পবিত্র পশু' পিতার সয়সম্পত্তি হারিয়ে কপর্দকহীন হয়ে পড়ায় এবং মা-বাবাকে হারিয়ে দু'চোখে অন্ধকার দেখা আমাদের মূল চরিত্র বিয়ে করতে বাধ্য হন এক বোবা মেয়েকে। আবু নসর মোক্তারের মেয়ে। সেই মোক্তার যার ষড়যন্ত্রে সর্বস্বহারা হয়েছিলেন নামহীন মূল চরিত্র।
ধূর্ত, ভিতু এবং সুবিধাবাদি উত্তম পুরুষে বয়ানকারী গল্পের মেইন ক্যারেক্টার বাকশক্তিহীন মেয়েটিকে বিয়ে করে অর্থনৈতিক ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেলেও মনের সংশয় এবং হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে। অন্যান্য নারীদের কথাবার্তা শুনার আগ্রহে সে অস্থির হয়ে পড়ে।
ছোটবোনকে গানের শিক্ষক ঠিক করে দেয়ার পর বাকশক্তিহীন স্ত্রীর মাঝেও "গোঁ, গোঁ" করে গান গাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠতে দেখা যায়। সমান্তরালে যেভাবে বাংলা ভাষার স্ফূরণের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে।
আমাদের গল্পের বয়াতী দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে অবিরত। একদিকে তাঁর কাপুরুষতা আবার অন্যদিকে প্রগতির দিকে একধরণের মোহগ্রস্থতা গল্পের পরতে পরতে ছিটিয়ে আছে।
ফিল্ড মার্শাল আইউব খান, তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ শ্বশুড় মোক্তার এবং তাদের ক্ষমতার সুবিধাভোগি বোবা মেয়েটির স্বামী প্রবল আন্দোলনে নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করে। তাঁর মধ্যে কাজ করে বিপন্নতা। এদিকে সঙ্গিতের স্বরতরঙ্গের পাশাপাশি শহিদ আসাদের মিছিলের উন্মাদনার যে ধ্বনি তা পুরো চেতনাজুড়ে স্পর্শ করে বোবা মেয়েটিকে।
হারমোনিয়াম নিয়ে বাকশক্তিহীন স্ত্রীর গান গাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে স্বাধীনতাকামী মিছিল ঘরের আশপাশ দিয়ে গেলে সকল দরজা-জানালা খোলা রেখে অব্যক্তকে ব্যক্ত করার প্রায় অসম্ভব ইচ্ছের প্রকাশ দেখে আমাদের বাঙালি মুসলমান চরিত্রটি স্ববিরোধী চিন্তাচেতনায় ভুগতে বাধ্য হয়।
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় সকল অঙ্গনে কুশলী একজন শিল্পী। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসে গল্পের প্লট অথবা চরিত্রের চেয়ে তিনি ধ্যান দিয়েছিলেন গদ্যকাব্যের ভঙ্গিমায় গল্পের প্রবাহমনতায়। দ্রুতগতিময়তা এবং স্বল্প কলেবরে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং বোবা স্ত্রীটির গাওয়ার বা বলার আকাঙ্ক্ষার যে পরিবর্তিত ব্যক্তিসত্ত্বা তা সমান্তরালে বলে গেছেন একজন দক্ষ গল্পকার হিসেবে আহমদ ছফা।
ভূমিকা লিখেছেন সুদিপ্ত হান্নান। পরিশিষ্ট - ১ এ আছে রশীদ করীম, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ এবং সলিমুল্লাহ খানের পাঠ আলোচনা। পরিশিষ্ট - ২ এ আছে আহমদ ছফার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি এবং একনজরে আহমদ ছফা গ্রন্থপঞ্জি।
'ওঙ্কার' মূলত এক প্রতিকী উপাখ্যান। তথ্যগত কিছু ভ্রান্তি ছাড়া ছফার অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণনায় যেখানে বাস্তব এবং কল্পনা একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
Discussion about this post
No posts