"মানুষের ব্যবহার হবে চাঁদের মতো নম্র ও ভদ্র। সূর্যের প্রতি মানুষের অভিযোগ বরাবরই বেশি। মানুষ প্রায়ই অভিযোগ করে আজকের সূর্যের তেজটা বড় বেশি। বৃষ্টির দিনে কেউ চায় বৃষ্টি আরেকটু কম হোক। কেউ চায় বেশি হোক। শীতের দিনে মানুষ অভিযোগ করে সূর্যের তেজ এতো কম কেন? আবার গরমের সময় বলে সূর্যের এতো তেজ কেন? কিন্তু চাঁদের প্রতি মানুষের কোন অভিযোগ নেই। চাঁদের দিকে তাকিয়ে সবাই মুগ্ধ হয়। জোৎস্না রাতে ছেলেমেয়েরা চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়া ধরার জন্য ছোটাছোটি করে। বড়রা মেতে থাকে গান, নাচ আর আড্ডায়। চাঁদ যেখানে যায় সেখানেই বয়ে নিয়ে যায় আনন্দ আর উৎসব। চাঁদের মতো নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী মানুষরা তাই সেরা মানুষ। সূর্য নয়, চাঁদই মানুষের আদর্শ চরিত্রের রূপক"
- কাবাতি গ্রামের এক বুড়ো।
এ লং ওয়ে গন (পৃষ্ঠা নং : ১৮)
ইসমাইল বোহে। একজন Rap Music এর একনিষ্ঠ ভক্ত। নিজের বড় ভাই জুনিয়র ও বন্ধুদের নিয়ে চারজনের এক টিম নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে যেতে চায় ইসমাইল। আকস্মিকভাবে পশ্চিম আফ্রিকার সিওরা লিওনে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেলে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সবার জীবনে পৃথিবীর মাটিতেই নেমে আসে নরক। ইসমাইল, তার পরিবার এবং বন্ধুরাও এই ভয়ানক যুদ্ধের যাতাকলে নির্মমভাবে পিষ্ট হতে থাকে।
নিজ আবাসস্থলে না থাকার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ইসমাইল, বড় ভাই জুনিয়র, টলোই ও মোহাম্মদ ভয়াবহ বিপদে পড়ে যান। যার যার মা-বাবা, ভাইবোনরা আদৌ টিকে আছেন কিনা তা পর্যন্ত জানা মুশকিল হয়ে পড়ে তাদের জন্য। RUF এর গেরিলাদের হাত থেকে সার্ভাইভ করার প্রত্যয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়াতে থাকেন ইসমাইল এবং আরো অনেকে। তাদের চোখের সামনে ঘটে যেতে থাকে নারকীয় এবং বিভৎস সব ঘটনা। প্রতিদিন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার ফলে যেন অতি ধীরে তাদের আত্মার শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে।
চাইল্ড সোলজার। আফ্রিকাসহ বিশ্বজুড়ে গৃহযুদ্ধে শিশু সৈনিকদের ব্যবহার করা হয়। তিক্ত অতীতের কারণে প্রতিশোধপরায়ণ এই শিশুরা আস্তে আস্তে প্রতিশোধ, ড্রাগ এবং খুনের নেশায় প্রায় পশুতে পরিণত হতে থাকে। ইসমাইল এবং তাঁর ভাই-বন্ধুরাও তীব্র প্রতিশোধস্পৃহায় পা রাখেন সেই চাইল্ড সোলজারের জীবনে। হত্যা, মাদকাশক্তি এবং উন্মাদনার তোড়ে তাদের মধ্যকার মানবিক সত্ত্বার ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। যেভাবে বিদ্রোহী গেরিলারা তাদের পরিবারের সদস্যদের বিনাশ করেছে ঠিক সেভাবেই নৃশংসভাবে তাঁরাও একই কর্মে নেমে পড়েন।
এক পর্যায়ে জীবনকে দ্বিতীয়বার শুরু করার অভাবনীয় সুযোগ ইউনিসেফ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও এনজিও সংগঠনের সহায়তায় ইসমাইল বোহে এবং আরো বেশ কিছু হিংস্র শিশু সৈনিক পেয়ে যান। তবে গেরিলা ওয়ারের খুনের নেশা, যুদ্ধকালীন মাদকের প্রভাব ও চিরাচরিত জিঘাংসা কাটিয়ে পুনরায় লেখাপড়া এবং সুস্থ ধারার জীবনে ফেরাটা একরকম সুকঠিন এক বিষয় হয়ে যায় তাদের কাছে।
ইসমাইল বোহে জাতিসংঘরের শিশু যোদ্ধা বিরোধি প্রতিনিধির সম্মানজনক পদ পেয়ে যান। কিন্তু যুদ্ধ আপনি ছেড়ে দিলেও যুদ্ধ কি আপনাকে সহজে ছাড়ে? বারবার স্বদেশভূমির উপর নেমে আসা সামরিক হস্তক্ষেপ ও স্বৈরাচারি শাসন ইসমাইলকে সিওরা লিওনে থাকতে দেয় না। বর্তমানে বোহে একজন বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী। বিশ্বজুড়ে স্বাপদ স্বরূপ চাইল্ড সোলজারদের পুনর্বাসন বা রিহ্যাবিলিটেশনে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি অবস্থান করছেন। তাঁর এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বহুল আলোচিত, সমাদৃত এবং তিরিশটির অধিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
কাউসার সারোয়ার বিভিন্ন বিষয়ে কিউরিয়াস একজন ব্যক্তি। পেশায় কৃষিবিদ, নেশায় লেখালেখির ঝোঁক তার। একদম ঝরঝরে ভাষায় কাউসারের প্রাঞ্জল অনুবাদ সুখপাঠ্য। যেন ইসমাইল বোহে বইটি বাংলায় লিখেছেন প্রায় এরূপ মনে হয়। পুরো গ্রন্থে অনুবাদের সক্ষমতায় আত্মজীবনীটি বাংলা ভাষায় চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন কাউসার সারোয়ার। তাঁর প্রতি অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে যে কেউ জিতে না এবং যুদ্ধ যে বাইরে থেকে ঝুনোমাথার পন্ডিতদের বিশ্লেষণ ও গবেষণার বিষয় হলেও ভিক্টিম বা আক্রান্তদের থেকে চরম মূল্য নিয়ে ফেলে তা 'এ লং ওয়ে গন' গ্রন্থে ইসমাইল বোহে প্রকাশ করেছেন।


